বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী তীরের কুতুবনগর ও বারইকরণ এলাকার ফসলি জমি, মাছের ঘের এবং বাড়িঘর রক্ষার জন্য সরকার ২০০০ সালে দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে। সেই থেকে বেড়িবাঁধের কুতুবনগর এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন কৃষক আবদুল হালিম (৫০)। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে নিয়মিত সংগ্রাম করে চলছেন তিনি। ঘূর্ণিঝড় সিড়র, আইলা, ফণি, আম্ফান ও ইয়াসের কবলে কয়েক দফায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যায় তাঁর চোখের সামনেই। এখন কোনো রকমে টিকে আছে তাঁর ঘরটি, তাও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় যাতায়াতের কোনো পথ নেই। শনিবার দুপুরে কুতুবনগড় এলাকায় গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, বাঁধটি মেরামত করা হলেও তা বেশি দিন টিকছে না। টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করায় ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে কিছুটা ক্ষতি হলেও ইয়াসে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায় বেড়িবাঁধটি। দুই শ একর ফসলি জমি, এক হাজার বসতঘর, মসজিদ মাদরাসা, দোকানঘর ও একটি খেয়াঘাট হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষক আবদুল হালিম বলেন, গ্যাছে বছর বেড়িবাঁধ কোনো রকমে মেরামত করা হইছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে বেড়িবাঁধ ক্ষতি হয়। এবার ইয়াসে পুরাই ভাইঙ্গা গ্যাছে। এহন পোলা-মাইয়্যা-নাতিগো লইয়্যা দুশ্চিন্তায় আছি। একটু জোয়ার অইলেই সব পানিতে তলাই্যয়া যায়। ক্ষ্যাতের ফসল পানিতে ডুইব্যা আছে। ঘরের মধ্যে পানি ওডে, বাঁধ না দেলে মোরা থাকমু ক্যামনে। টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি করেছেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, নদীর পাড়ে আমার দোকান আছে। বেড়িবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে এমন অবস্থা অইছে, দোকানডাও কোন সময় শ্যাষ অইয়্যা যায় আল্লাহ জানে। মোগো বাঁধ হপালে ঠিক কইর্যা দিতে কইয়েন। বারইকরণ খেয়াঘাট এলাকায় একটি এতিমখানার পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বাঁধটি নির্মাণের পর ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক দফায় ভাঙে। আবার সংস্কারও করা হয়। কিন্তু টেকসই বেড়িবাঁধ না দিলে কিভাবে টিকবে। একটু জোয়ারের পানি বাড়লেই বাঁধ ভাঙে। এখন আমাদের এতিমখানা ও একটি মসজিদ হুমকির মুখে রয়েছে। আমরা টেকসই বেড়িবাঁধ চাই। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা ও বিষখালী নদী তীরের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত হয়। মাঝে মধ্যে সংস্কার হলেও বেশিরভাগই অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে বেড়িবাঁধের ৮টি এলাকার প্রায় চার কিলোমিটার ভেঙে যায়। ফলে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে বসতঘর, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের। দুর্ভোগে পড়া নদী তীরের বাসিন্দারা দুর্বিষহ রাত কাটাচ্ছেন। এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে পানি বেড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁঠালিয়া উপজেলা বিষখালী নদীর বেড়িবাঁধটি। ৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের তিন কিলোমিটাররের বিভিন্ন স্থান ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত ও বসতঘর। পানি ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন স্থাপনায়। এছাড়াও সদর উপজেলার গাবখান-ধানসিঁড়ি, দেউরী বেড়িবাঁধ, কৃষ্ণকাঠি এলাকায় শহর রক্ষাবাঁধ ও বিষখালীর নদীর হদুয়া এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কাঁঠালিয়া গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মো. কিবরিয়া বলেন, এক জোয়ারেই পানি অনেক বাড়ছে। এহোন বেড়ি ভাইঙ্গা ওই পাশ দিয়্যা ছুইট্ট্যা গ্যাছে। এতে আমাগো কৃষির অনেক ক্ষতি হইছে। গাছের মরিচ ও ডাইল তুইল্লা নেওয়া যাইবে না। পানিতে আমাগো বাড়িঘর তো পুরাই ডুইব্বা গ্যাছে। বিষখালী নদী তীরের বাসিন্দা আবদুর রব খান বলেন, ঝড়-বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসলে আমরা খুবই আতঙ্কে থাকি। বিশেষ করে রাতে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসে থাকতে হয়, কখন বাড়িঘর ভেঙে নদীতে চলে যায়। ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, ঝালকাঠি জেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য তিন কোটি টাকার প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কাজ শুরু করা হবে।
Leave a Reply